আজ  শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪


করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

  আফছার উদ্দিন লিটন:   |   আপডেট: ০৩:১০ এএম, ২০২১-০৪-২০    889

 

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান


 

করোনাভাইরাস। এক অদৃশ্য ভাইরাস। যার নির্দয় আচরনে পুরো পৃথিবী আজ নি:স্ব। এলোমেলো। মানুষ অসহায়। সব কিছুই আজ আঁধারে ঢাকা। নিস্তব্ধ। বিষন্নতায় ঘিরে ধরছে চারপাশ। তবুও মানুষ বাঁচতে চাই। তবুও মানুষ স্ব¯ি’ পেতে চাই এ মহামারি থেকে। কিš‘ এ মহামারি কি মানুষকে স্ব¯ি’ দিবে? এ মহামারি কি মানুষকে তার পাপ থেকে মুক্তি দিবে? ভ্যাকসিন তো দূরের কথা এর সমাধান স্বয়ং আল্লাহও মিলাতে পারছে না। এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয় আজ কোনো কিছু। মুক্ত নয় অর্থনৈতিক খাত। মুক্ত নয় শিক্ষা খাতও। করোনাকালে শিক্ষা খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে।
করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। তাই এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেতন না পাওয়ায় খুবই বেকায়দায় আছেন। জাতির বিবেক এবং মানুষ গড়ার কারিগড়রা আজ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কেউ কেউ স্কুলের চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। কেউ কেউ স্কুলের চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান।কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে অক্ষম হওয়ায় স্কুল বিক্রির নোটিশ দিয়ে তাদের অসহায়ত্বেও কথা সরকারকে জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ স্কুল রক্ষার জন্য লড়াই করে যা”েছ। কোনো কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও পরিচালকরা স্কুলের কয়েকটি কক্ষ ভাড়া দিয়ে কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছেন।

শিক্ষার উন্নয়নে এই সরকার অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশ ডিজিটাল হওয়ার কারণে অনলাইনে ক্লাস চলছে। ভার্চুয়াল ক্লাস হলেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা খুব বেশি উপকৃত হতে পারছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হ”েছ। তাই যত দ্রæত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার এমন দাবি এখন সাংসদ থেকে নিয়ে আমজনতার মুখে মুখে।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার পর ৩০ মার্চ স্কুল খোলার সংবাদ সকলের জন্য স্বস্তির ছিল। এর ব্যতিক্রম নয় অভিভাবকদের মাঝেও। শিক্ষার্থীরা স্কুল খোলার সংবাদে আনন্দে ভাসতে থাকে। করোনাভাইরাস মহামারিতে এক বছর ধরে স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ফাঁকা। সেখানে বিরাজ করছে এখন সুনসান নীরবতা। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক স্কুল-কলেজ এখন ভুতুড়ে ঘরে পরিণত হয়েছে। যাই হোক, স্কুল খুলছে ৩০ মার্চ। এমন খুশির সংবাদে স্কুল-কলেজগুলোতে হয়েছে পরিষ্কার-পরি”ছন্নতার কাজ। কিš‘ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মাধ্যমিক ও উ”চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিনক্ষণ আবার পিছিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার ২৫ মার্চ রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ঈদ উল ফিতরের পর ২৩ মে থেকে স্কুল-কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
পরে রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং সংশ্লিষ্ঠদের সাথে আলোচনা করে নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। এর আগে, গত ২৭ ফেব্রæয়ারি শিক্ষামন্ত্রী আর্ন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে ৩০ মার্চ দেশের সব স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ২৪ মে থেকে শুরু হওয়া এবং ১৭ মে থেকে হল খোলার কথাও বলেছিলেন। ১৭ মের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের করোনা টিকা দেয়া হবে। এছাড়া বিসিএস পরীক্ষার আবেদন ও পরীক্ষার তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করার কথা রয়েছে।

দেশে করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মাধ্যমিক ও উ”চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিন আবারও পেছানো হয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিবেচনায় এবং কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সাথে পরামর্শক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আগামী ঈদ উল ফিতরের পর ২৩শে মে থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই সময়ে স্বা¯’্যবিধি মেনে চলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান মন্ত্রী।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।পরে কওমি মাদ্রাসাগুলো খোলার অনুমতি দেয়া হলেও অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার অনুমিত দেয়নি কর্তৃপক্ষ। ডিসেম্বরের মধ্যে পরি¯ি’তির যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে ২০২০ সালের জেএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।এছাড়া কোন শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সব শিক্ষার্থীকে 'অটো-পাস' দেয়া হয়েছে।
মহামারি পরি¯ি’তির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় গত ২৭ ফেব্রæয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নিলেও চলতি মাসে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ফলে, আবারও নতুন সংকটে পড়ে যায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকবৃন্দ।
করোনা সংকটে কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে মানববন্ধন করেন শিক্ষকেরা। এ নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ কিন্ডাগার্টেন স্কুল-কলেজ এসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে আর্থিক প্রণোদনা, বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকেরা।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি (বুধবার) জাতীয় সংসদের অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণে ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী  মোতাহের হোসেন ও সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রæত খুলে দেয়ার দাবি জানান। করোনাভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট পরি¯ি’তিতে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ক্লাস হলেও তা যথেষ্ট নয়। এ অব¯’ায় শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে স্বা¯’্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রæত খুলে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেন।
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে  ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কাতারভিত্তিক এডুকেশন এভাব অল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ভার্চুয়াল সেমিনারে তার বক্তব্যে বলেন, শিক্ষাখাত কোভিড-১৯ এর কারণে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষাখাতকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র উলে­খ করে চলমান করোনাভাইরাস সঙ্কটের সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহŸান জানিয়েছেন।এই দিবসটি শিক্ষার ওপর হামলার ইস্যুতে আলোকপাত এবং সংঘাত-আক্রান্ত দেশগুলোতে আরও প্রান্তিক শিশু ও যুবকদের মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ পেতে সহায়তা করার লক্ষ্যে পালিত হয়েছে।
এতেই শেষ নয়; আরো আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক পরিস্থিতিতে শিক্ষাখাত রক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নতুন করে জোরদারের অঙ্গীকার করেছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিভিন্ন দেশকে কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে।
যদিও কোভিড-১৯ সঙ্কট বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা দেখিয়েছে। তাসত্তে¡ও বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে মহামারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সরকার বসে থাকিনি। সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে স¤প্রচারিত এবং অনলাইন পাঠদান চালু করেছে। সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনায় নিযুক্ত থাকে। সরকার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করায় এই ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়েছে।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাকে দেশের উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হয়ে সরকার শিক্ষায় ব্যাপক বিনিয়োগ করে যা”েছ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার উন্নতি এবং বিশেষ প্রয়োজন-সম্পন্ন শিশুসহ প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। সে লক্ষ্যে সরকার ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে এবং উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত ২০.৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান করে যা”েছ। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মেয়েদের পড়াশোনা বিনামূল্যে করা হয়েছে।২৬ হাজার ১৯৩টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬৮৫টি উচ্চবিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে এবং ৪ হাজার ৩৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মাসিক বেতন আদেশের (এমপিও) আওতায় আনা হয়েছে।লিঙ্গ-সংবেদনশীল পন্থা, স্কুলে খাওয়ানো কর্মসূচি, প্রায় প্রতিটি গ্রাম ও ওয়ার্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, আইসিটি শিক্ষার মতো অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি এই সমস্ত পদক্ষেপের সুস্পষ্ট সুফল দেখা যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, ২০১৯ সালে প্রকৃত শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৯৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং স্বাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণেও পদক্ষেপ নিয়েছে।
   

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম-এর করা জানুয়ারি ২০২১ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২১)। এ জরিপে দেখা যাচ্ছে, করোনাকালীন এ দুর্দিনেও বৈষম্য বেড়েছে-অর্থাৎ দরিদ্ররা যত বেশি হারে দরিদ্র হয়েছেন, ধনীরা সেই হারে সম্পদ হারাননি। ধনীরা আরও সম্পদ সঞ্চয় করেছেন।
এ জরিপের একটি উলে­খযোগ্য দিক হচ্ছে শিক্ষা খাতে অংশগ্রহণের হারে হ্রাস। ওই জরিপে দেখা যাচ্ছে, ‘২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষা ব্যয় কমেছে। অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য এ হার হ্রাস সবচেয়ে বেশি ৫৮ শতাংশ। পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও কম। এ তথ্য অবশ্যই বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মহামারির এক বছর পার হওয়ার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, আর যত ধরনের ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো পুষিয়ে নেয়ার পথ পদ্ধতি হয়তো বের করা যাবে; কিন্তু যে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, তা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে একটি পুরো প্রজন্মই পিছিয়ে পড়েছে।শিক্ষার্থীরা মানসিক বিষন্নতায় ভুগছে। একই অব¯’া শিশুদের ক্ষেত্রেও। নির্দয় করোনা তাদের কোমল কচি হৃদয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

শিক্ষার অধিকার যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দিয়েই নির্ধারিত হয়, সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়; কিন্তু করোনাকালে তা আরও বেশি প্রকট রূপ লাভ করেছে যখন অনলাইন শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাসে ইউনেস্কোর হিসাবে দেখা গিয়েছিল, সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮৩০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী- যা মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেক ইন্টারনেট এক্সেস নেই। ফলে করোনাকালে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে যারা শিশু শিক্ষার্থী, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ কারণে যে, তাদের একাংশ শিক্ষা থেকেই ঝড়ে যেতে পারে। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৯০ লাখ শিশু শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, এ ঝরে পড়ার হার সর্বত্র এক রকম হবে না। দরিদ্র দেশগুলোতে এ হার অন্যদের চেয়ে বেশি হবে। ধনী দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী-এর শিকার হবে। আর যেখানে এ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা হচ্ছে সেসব দেশ যেখানে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ এবং শিক্ষার মানের ব্যাপারে ব্যাপক উদাসীনতা থেকে এটি সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশকে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের যে কোনো ধরনের সর্বাত্মক বা কমপ্রিহেনসিভ পরিকল্পনা ও কৌশল নেই, তা ইতোমধ্যেই সুস্পষ্ট। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া না দেয়া নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এবং একসময় অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হবে। কিন্তু এ আলোচনায় যা অনুপস্থিত তা হচ্ছে কেবল সময়ের বিবেচনায় নয়-মানের বিবেচনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য কি পরিকল্পনা করা হচ্ছে?
শিক্ষা খাতের বৈষম্যের সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া এবং বড় প্রভাব হচ্ছে গোটা জীবনচক্রেই তার প্রতিফলন ঘটে-কে কতটা আয় করতে পারবেন, সেটি যেমন এতে নির্ধারিত হয়, তেমনি নির্ধারিত হয় ওই ব্যক্তি কতটা স্বাস্থ্য সুবিধা লাভ করবেন, তার আয়ু কত হবে। বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়লেও সমাজের দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতরাও একই মাত্রার আয়ু লাভ করেন সেটি মনে করার কারণ নেই। করোনাভাইরাস আগামীতে এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে কিনা সেটি এখন থেকেই নজরে রাখা দরকার। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে, অন্যান্য অনেক মধ্য আয়ের এবং দরিদ্র দেশের মতোই, এক বড়সংখ্যক মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। গত বছরের জুলাই মাসে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ নামীয় একটি প্রতিষ্ঠানের এক জরিপের তথ্য অনুসারে, ‘দরিদ্র পরিবারগুলোর পাঁচ শতাংশই দিনে মাত্র একবেলা খেয়েছেন। অথচ মহামারি শুরুর আগে উত্তরদাতাদের ৯১.৬ শতাংশ দিনে তিনবেলা এবং বাকিরা দুবেলা খাবার খেতে পারতেন’ (বিডিনিউজ২৪, ১৬ জুলাই ২০২০)। পুষ্টির সংকট নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের এক বড় প্রতিবন্ধক; যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগেই চিহ্নিত হয়েছে। মহামারির প্রভাবে এটি যে আরও বড় আকার নেবে সেটি বিবেচনায় নেয়া দরকার।
সারা বিশ্বজুড়েই যেসব বিষয় এখন আলোচনার এবং উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা খাতে করোনাভাইরাসের এ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। একটি প্রজন্ম যেন শিক্ষা খাত থেকে হারিয়ে না যায়, ইতোমধ্যে যে বিশাল বৈষম্য আছে তা যেন আরও বৃদ্ধি না পায়, মানের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি কিভাবে মোকাবিলা করা যায়। এজন্য দরকার হচ্ছে বহুমাত্রিকভাবে এ সমস্যাকে বিবেচনা করা। করোনাভাইরাসের ক্ষতি কেবল অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাই যথেষ্ট নয়।

২০২০ সালের ১ নভেম্বর (রবিবার) সকালে কোভিড-১৯ ও বাংলাদেশ: আর্থসামাজিক পুনরুজ্জীবনে যুব এজেন্ডা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে এ তথ্য তুলে ধরে বেসরকারি সংগঠন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ। সংগঠনটি ১৮ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ১৬৩ জনের ওপর অনলাইনে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করে। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৬৩ জন পুরুষ, ২৯৯ জন নারী এবং ১ জন তৃতীয় লিঙ্গের।
মহামারির কারণে প্রযুক্তিগত বৈষম্য, শিক্ষা ও দক্ষতা এবং কর্মসং¯’ানের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে বলা হয়, নারীদের মধ্যে ৮ শতাংশ বিয়ের কারণে পড়াশোনা ছেড়েছে। আর পরিবারকে সহায়তা করার জন্য ছেড়েছে ১৩ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে এটি ৩২ শতাংশ।

দুই-তৃতীয়াংশ ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। কোভিডে তরুণ-যুবাদের মানসিক স্বা¯ে’্যর ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ৯৬ শতাংশ জানিয়েছে, তারা নানা ধরনের মানসিক অবসাদে ভুগছে। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশের অবসাদ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। অনলাইনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে যুক্ত নেই ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে শিক্ষা ও কর্মসং¯’ানে বিপুলসংখ্যক তরুণযুবক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। আর্থিক দুর্বিপাকে পড়া পরিবারকে সহায়তা করতে তাঁদের ২৮ শতাংশ পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আয় কমে গেছে ৮০ শতাংশের। আয়ের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্রও রয়েছে। এই সংকটেও ১২ শতাংশের আয় বেড়েছে।
শুধু তাই নয়, করোনাকালে শহর ও গ্রামের মধ্যে এবং নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে ত্রিমাত্রিক লিঙ্গবৈষম্য দেখা দিয়েছে। এই বৈষম্যগুলো শনাক্ত করে বাজারের চাহিদার সঙ্গে দক্ষতার সমন্বয় কিভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
এসব গবেষণায় আরো উঠে এসেছে যুবসমাজের একটি অংশ শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে। অপর একটি অংশ বি”িছন্ন অব¯’ায় রয়েছে। কেউ মাদকে যুক্ত, কেউ অবসাদে ভুগছেন। তাই অখন্ড নয়, বিভাজিতভাবেই যুবাদের দেখতে হবে এবং তাঁদের কিভাবে সক্রিয়ভাবে কর্মসং¯’ানে যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পলিটেকনিক, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ১০ থেকে ১৫ শতাংশের পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের মতে, দক্ষ কর্মশক্তি তৈরির জন্য কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারে নিয়ে আসতে হবে। সরকারকে সংকটকালে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে শর্ত সাপেক্ষে আগামী ছয় মাসের বেকার ভাতা দেয়া উচিত তরুণ-যুবকদের।
শিক্ষকেরা জাতির বিবেক। মানুষ গড়ার কারিগর। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা প্রায় দেড় কোটি শিশুকে একাডেমিক শিক্ষা ও এক কোটি শিশুকে সাংস্কৃতিক শিক্ষাসেবা দান করে আসছেন। মহামারি করোনার প্রভাবে এই সেক্টরের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষক, কর্মচারী ও পরিচালক আজ অসহায় ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তারা কোথাও ত্রাণের জন্য হাত পাততে পারছে না। আবার তাদের এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকগুলোও ঋণ দিতে চায়না। এতে তারা দিন দিন নি:স্ব হ”েছ। সর্বস্বান্ত হ”েছ। অনেক শিক্ষক না খেয়ে ধুকে ধুকে মরছে। দুর্যোগকালীন এ পরি¯ি’তি থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর সুনজরের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রায় সব কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হয়। দেশে এ রকম প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৬৫ হাজারের মতো। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ১২ লাখ। শিক্ষার্থী আছেন প্রায় দেড় কোটি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত টিউশন ফি দ্বারা পরিচালিত হয়। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এরপর থেকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎসও বন্ধ। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনও দেয়া সম্ভব হ”েছ না। এ দুরাঅব¯’া চলতে থাকায় অনেক কিন্ডাগার্টেন স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়েছে। এ অব¯’া আরও চলতে থাকলে ৫-৬ মাসের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। লাখো শিক্ষক, কর্মচারী ও পরিচালক বেকার হয়ে যাবেন।


এ অব¯’া থেকে পরিত্রাণের জন্য দেশের সকল জেলায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও কলেজের শিক্ষক ও পরিচালকরা  মানববন্ধনে শিক্ষকদের পক্ষে কয়েক দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবি গুলো হলো বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরি¯ি’তির দুর্যোগকালে কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও কলেজের পরিচালকদের উদ্যোক্তা ঘোষণার মাধ্যমে আর্থিক প্রণোদনা এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যব¯’া করা।
কিন্তু করোনার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলায় আবারও এই স্কুলগুলো নতুন করে সংকটে পড়েছে। কিন্ডারগার্টেনগুলোর উদ্যোক্তারা চাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলগুলো খুলে দেয়া হোক। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  তাঁরা স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খোলার বিষয়ে  প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেও শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করেই বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছেন।

-- লেখক: আফছার উদ্দিন লিটন, সাংবাদিক ও গবেষক

 

 

 

 

 

 

রিলেটেড নিউজ

তরুণ প্রকাশকদের অংশগ্রহণে তিনদিনব্যাপী ‌‌প্রশিক্ষণ কর্মশালার সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন

চট্টলার ডাক ডেস্ক: তরুণ প্রকাশকদের অংশগ্রহণে তিনদিনব্যাপী ‌‌'সৃজনশীল প্রকাশনা খাত: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা' শীর্�...বিস্তারিত


মুসা (আ.) এর আমলে দীর্ঘদিন বৃষ্টি বন্ধ ছিলো!

মো. ইউছুফ চৌধুরী হযরত মুসা (আ.) এর আমলে দীর্ঘদিন যাবত বৃষ্টি বন্ধ ছিলো। তাঁর উম্মতরা তাঁর কাছে এসে বললো “ হে নবী, আল্�...বিস্তারিত


আল-আমিন হাসপাতাল (প্রা.) লিমিটেড

চট্টলার ডাক ডেস্ক: আল-আমিন হাসপাতাল (প্রা.) লিমিটেড ৮৩০, জাকির হোসেন রোড, একে খান মোড়, উত্তর পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম। ...বিস্তারিত


চট্টগ্রামের একে খান মোড়ে রাজমহল রেস্তোরাঁ এন্ড বেকার্সের উদ্বোধন

চট্টলার ডাক ডেস্ক: নগরীর একে খান মোড়ে সুপার রাজমহল রেস্তোরাঁ এন্ড বেকার্সের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়েছ। সোমবার, ২৯ �...বিস্তারিত


আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি

আফছার উদ্দিন লিটন: অধ্যক্ষ শামসুদ্দিন আহমেদ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধ...বিস্তারিত


ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল আমরা পদে পদে টের পাচ্ছি

আফছার উদ্দিন লিটন ও এলেন ভট্টাচার্য অনিক লায়ন একে জাহেদ চৌধুরী। চট্টগ্রামের নাজিরহাট পৌরসভার মেয়র। অত্যন্ত বিনয়ী এবং সাংস্কৃতিকবান্ধব এ�...বিস্তারিত