আজ  মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪


মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ার গৈড়লার টেকের সম্মুখযুদ্ধ

  ফজল আহমদ   |   আপডেট: ০৭:৫০ পিএম, ২০২১-০২-১৭    449

 

মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ার গৈড়লার টেকের সম্মুখযুদ্ধ


একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর পটিয়ার গৈড়লার টেকের যুদ্ধ চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি আলোচিত সম্মুখযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দক্ষিণ চট্টগ্রামে এত বড় যুদ্ধ আর হয়নি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর দোসর রাজাকার আল শামস ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর আলোচিত ও সাহসিকতাপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধ সংঘঠিত হয়। ওই যুদ্ধে শতাধিক পুলিশ ও রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। রাজাকার, মিলিশিয়া, বিহারি লরি ড্রাইভার ও হেলপার এবং পুলিশের লোক মিলে দখলদার বাহিনীর দোসরদের মোট ১৪ জন এই সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়। এই যুদ্ধে গেরিলা বাহিনী সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ গেরিলা বাহিনীর হাতে আসে। যুদ্ধে গেরিলা বাহিনী নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে।
    ১৯৭১ সালে আমি স্কুল ছাত্র ছিলাম। এই অভিযানে আমি স্থানীয় ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা ছিলাম। দলের কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম। যিনি পরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হন। গৈড়লার টেকের সম্মুখযুদ্ধের গেরিলা সদস্যরা হলেন মোহাম্মদ শাহ আলম-কমান্ডার, উদয়ন নাগ-ডেপুটি কমান্ডার। রাঙ্গুনিয়া মরিয়মনগরের মোহাম্মদ ইউছুফ (পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য), পাবনার শামশুজ্জামান হীরা, আমি, পটিয়া ধলঘাটের তপন দস্তিদার, শেখর দস্তিদার (পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরগ্রহণ), পটিয়া তেকোটার সুজিত কুমার বড়–য়া, রাঙ্গুনিয়া সরফভাটার আনোয়ার হোসেন, পটিয়া ছনহরার প্রিয়তোষ বড়–য়া, পটিয়া রতনপুরের পুলক দাশ, মিরসরাইয়ের কামরুজ্জামান।  পাবনার মোয়াজ্জেম হোসেন, বোয়ালখালী শাকপুরার সুনীল চক্রবর্তী,  ঢাকার আনোয়ার, ভূপাল দাশগুপ্ত, মোহাম্মদ আলী। চট্টগ্রামের পূর্ব বাকলিয়ার মিয়া জাফর আহমদ, রেল কর্মচারী অসিত দাশ, বন্দরের শেখ মানিক ও কক্সবাজারের পীযুষ বড়–য়া।
    ধলঘাট ইউনিয়নের সে সময়কার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ঈশ্বরখাইন নিবাসী মাওলানা ইমাম শরীফ বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে দখলদার বাহিনীর নানা সংবাদ গোপনে সরবরাহ করতেন। তিনি আমাদের জানালেন পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও সাতকানিয়া থানার সকল পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র ও গুলির বাক্সসহ পটিয়া থানায় সমবেত হয়েছে। তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কথা ভাবছে। আমাদের কমান্ডার মো. শাহ আলমের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি ওদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সাব্যস্ত হয় ৯ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে ৯টায় ধলঘাট ডিআইবি ক্যাম্পের নিকটবর্তী কোনো স্থানে ওই পুলিশ বাহিনী আমাদের গেরিলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ধলঘাট ক্যাম্পের প্রবেশ পথে আমরা এমবুশ করে আছি সকাল সাতটা থেকে। নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও আত্মসমর্পণকারীরা নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হলো না। একটু পরে পটিয়ার ফাইনাল রেকি করতে যাওয়া দু’জন ফিরে এল। তাদের কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল, পুলিশ বাহিনীর সকল সদস্য ধলঘাটে এসে আত্মসমর্পণে একমত নয়। তাদের বড় একটি অংশ শহরে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পরিকল্পনা পাল্টাতে হল। সিদ্ধান্ত হল গৈড়লার টেকে তাদের যানবাহনে এমবুশ করব। আমরা দ্রুত গৈড়লার টেকে চলে গেলাম। জায়গাটা কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডারদ্বয় ও হীরা ভাই ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিলিং জোন নির্ধারণ করলেন। পাকা সড়ক থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে লম্বা লাইনের ধানক্ষেত ও জমিনের আলকে আড়াল করে অবস্থান নিলাম ফ্রন্ট কাট অফ হিসেবে। তাদের উপর অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্যান্য গাড়িগুলোকে আটকে দেওয়া। তিনজনের একটি দল রিয়ার অফ হিসেবে শাহগদি মার্কেটের দিকে অবস্থান নিল। সেই দলের উপর বাড়তি দায়িত্ব ছিল শহর থেকে আসা গাড়িগুলোকে আটকে দেয়া। মূল অপারেশনের আগেই প্রথমে রিয়ার কাট অফদের সাথে সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়ল তিন মিলিশিয়া ও চার রাজাকার। এদিকে পুলিশের বাস আসার আগেই কিলিং জোনে এসে ঢুকল আজিজ নগর থেকে চট্টগ্রাম শহর অভিমুখী রমনা সিগারেট বোঝাই একটা ট্রাক। ওই ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপার ছিল বিহারি। ফ্রন্ট কাট অফদের সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে ট্রাকটি দ্রুত পালাচ্ছিল। পুরো কিলিং জোন নির্বিঘেœ অতিক্রম করে গেল ট্রাকটি। চাকা লক্ষ করে গুলি করেও দ্রুত ধাবমান ট্রাকটিকে থামানো যায়নি। কিন্তু কিলিং জোন পার হওয়ার মুখে পালবাড়ি ঘটায় (সদর দরজা) রিয়ার কাট অফরা ড্রাইভারকে লক্ষ করে গুলি করে খতম করল। ট্রাক ছিটকে পড়ল রাস্তার পাশে। পালানোর পথে হেলপারও গুলি খেয়ে মারা গেল। দুপুর বারোটার কিছু পরে পুলিশ বোঝাই বাস কিলিং জোনে ঢুকলো। কমান্ডার কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম আকাশের দিকে গুলি ছুড়লেন তার স্টেনগান থেকে। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আকাশের দিকে দুয়েক রাউন্ড গুলি করল। হীরা ভাইও তেমনিভাবে এলএমজি থেকে কয়েক দফা ব্রাশ ফায়ার করলেন। এ অবস্থায় পুলিশ বাহিনী তাদের বাস থামিয়ে জানালা দিয়ে অস্ত্র ফেলে দিতে শুরু করল। কমান্ডার শাহ আলমম তা দেখে উচ্চ:স্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘সিস ফায়ার’ আত্মসমর্পণ করো। কিন্তু আশ্চর্য্যরে ব্যাপার হল, মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোঁড়া বন্ধ করতেই শুনতে পাই পাল্টা ফায়ারিং এর আওয়াজ। বাসগুলো থেকে কয়েকজন নেমে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল।
কয়েকজনের পরনে ছিল রাজাকারের পোশাক, আবার কারও পরনে লুঙ্গি ও শার্ট। কেউ কেউ গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়েও যাাচ্ছিল। ওদের ছোড়াগুলি সোঁ সোঁ শব্দ করে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় ওই লোকগুলোকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া ছাড়া আমাদের গন্ত্যন্তর ছিল না। ফলে ওখানে ওদের পাঁচজন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এরপর ওই বাসগুলোর দিকে আসা গুলির আওয়াজ বন্ধ হয়। বুঝতে বাকি রইল না কেন ওরা পুর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধলঘাটে আত্মসমর্পণ করেনি। পুলিশদের মধ্যে একটা অংশ এবং তাদের সাথে থাকা কিছু রাজাাকর ও মিলিশিয়া সদস্য এই আত্মসমর্পণের পক্ষে ছিল না। তারা শহরে ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিল। পুলিশের বিরাট অংশ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে এ তথ্য তাদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তারা সম্ভবত পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে সে তথ্যও প্রেরণ করেছিল। এই অনুমানের কারণ হল, গৈড়লার টেকে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন পাকিস্তানি বাহিনীর একটা দল দুটো পিকআপে করে শহর থেকে পটিয়ার দিকে আসছিল। এর আগে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের একটা দল পটিয়ার দিকে আসতে গিয়ে আমাদের হাতে ধরা পড়ে খতম ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর যে দলটি শহর থেকে পটিয়ার দিকে আসছিল তারা মনসা বাদামতলে এসে এলএমজি ও স্টেনগানের ব্রাশফায়ারসহ ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ পেয়ে আবার শহরের দিকে ফিরে যায়। একইভাবে আমাদের এমবুশে গড়া বাহিনীর পেছনেও পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর পিকআপ ছিল সেগুলো কাগজীপাড়া মসজিদ থেকে ফিরে যায়।

ফজল আহমদ, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম।

 

রিলেটেড নিউজ

নারী শুধু ঘর সামলায় না

মো. বেলাল হোসেন চৌধুরী ‘নারী মাঠে যেতে পারে না’-এ কথা আমরা বলতে চায় না। তারা সব পারে; কিন্ত পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান �...বিস্তারিত


দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না কেউ

মো. বেলাল হোসেন চৌধুরী (১) আমি শুধুশুধু অনর্থক যেই ভদ্রলোকটার  বিরুদ্ধে আক্রোশ বা ষড়যন্ত্র করি, পরবর্তীতে দেখা যায় তার অ�...বিস্তারিত


দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত

মো. ইউছুফ চৌধুরী দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়, আল্লাহর প্র�...বিস্তারিত


মুসা (আ.) এর আমলে দীর্ঘদিন বৃষ্টি বন্ধ ছিলো!

মো. ইউছুফ চৌধুরী হযরত মুসা (আ.) এর আমলে দীর্ঘদিন যাবত বৃষ্টি বন্ধ ছিলো। তাঁর উম্মতরা তাঁর কাছে এসে বললো “ হে নবী, আল্�...বিস্তারিত


বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষার্থীদেরকে এগিয়ে দেয়ার জন্য সিএসবিএইচ বদ্ধ পরিকর

আফছার উদ্দিন লিটন: কলেজ অব সায়েন্স বিজনেস এণ্ড হিউমেনিটিঁজ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সন্নিকটে পাঁচলাইশ�...বিস্তারিত


চরম বিরোধীর কথাও মনোযোগী হয়ে শুনতেন নবীজী (সা.)

মো. ইউছুফ চৌধুরী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়তের প্রাথমিক সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল একেবারে ক�...বিস্তারিত