আজ  মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪


মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

  আফছার উদ্দিন লিটন:   |   আপডেট: ০১:১৩ এএম, ২০২১-০১-০৩    546

 

মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

 

কবি, অধ্যাপক আলেয়া চৌধুরী। একজন বিশিষ্ট লেখিকা। জীবনের দীর্ঘ সময় শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়েজিত ছিলেন। মহান একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অনার্স পরীক্ষা দেয়ার সময় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে আলেয়া চৌধুরীর পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে বাংলায় অনার্স সহ মাস্টার্স পাশ করেন। তার সহপাঠীদের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কাজী রোজী, জেসমিন আমিন, সাংবাদিক নুহ আলম লেলিন, হীরাফুল, নিরঞ্জন অধিকারী, আক্তার-উর-নবী,  বর্তমান সাংসদ শফিকুর রহমান, প্রয়াত বেবী মওদুদ, প্রয়াত সেলিম আলদীন,  প্রয়াত মো. আব্দুল আউয়াল মন্টু’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
 
আলেয়া চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২৮শে ফেব্র“য়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার  কোয়েপাড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের মেয়ে। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব মরহুম হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরী, মা মিসেস হাসিনা বেগম চৌধুরী। তাঁর স্বামীর নাম এ.এম.এম সালেক। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। পুত্র সন্তান ডা. কামরুল আহসান শুভ ও পুত্রবধু ডা. হোসনে আরা দু’জনেই (এফসিপিএস)। কন্যা সন্তান-ফাহিমা সালেক। স্বামী মো. শাহে এমরান। ব্যক্তিগভাবে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ ও চট্টগ্রাম রোটারি ক্লাব রোজ গার্ডেনের আজীবন সদস্য।

আফছার উদ্দিন লিটন: আপনার শৈশব কেটেছে কোথায়?

আলেয়া চৌধুরী : আমার বাবা হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরী একজন ন্যায়নিষ্ঠ, আদর্শবান চৌকষ পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। প্রিয় মা হাসিনা বেগম চৌধুরীর একান্ত আদর, স্নেহ মমতা ও ভালবাসায় নেত্রকোনা, মির্জাপুর, পূর্বধলা ও ময়মনসিংহে আমার শৈশব কেটেছে সরকারি বাসভবনে।

 

আফছার উদ্দিন লিটন :আপনার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পড়ালেখা কোথায়?

আলেয়া চৌধুরী : বাবার সরকারি চাকরির কারণে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানাধীন মির্জাপুর হাইস্কুল থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়াশোনা করেছি। এরপর ঢাকার মুসলিম গার্লস হাইস্কুল যা বর্তমানে আনোয়ারা গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে রূপান্তর হয়েছে। সেখান থেকে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছি। তখন থেকেই নাচ, গান, নাটকে অংশগ্রহণ করেছি। সিরাজউদৌল্লা নাটকের আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করে অনেক সুনাম হয়েছিল। বিভিন্ন থানায় ছোট ছোট শিশুদের সাথে নাচ,গান, অভিনয় করে জীবনকে বর্ণিল আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিলাম। তখন থেকে মানুষের প্রতি আমার সেবা, সহযোগিতা, ভালবাসা সবার চোখে পড়েছিল।

আফছার উদ্দিন লিটন: আপনি উচ্চ শিক্ষা করেছেন কোথায়?

আলেয়া চৌধুরী : ঢাকার বদরুননেসা গার্লস কলেজ (আদি ইডেন কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এম.এ করেছি। ইডেন কলেজে থাকাকালীন ৬৬তে আজকের রোল মডেল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সহ-সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৫ ভোটে হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিপুল ভোটে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্র“পের অন্য সদস্যরা জিতেছিল। তাঁদের মধ্যে আজকের স্বনামধন্য জিনাত বরকতউল্লাহ (সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা) পদে জয়ী হয়েছিল। ছাত্রলীগের সাইদা গাফ্ফারও জিতেছিল। তাঁদের এবং সব বন্ধুদের যেমন লেলিন, কনা, বেলি, মিনু, জেসমিনকে অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা।

আফছার উদ্দিন লিটন: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার ক্লাস সহপাঠি ছিলেন। সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?

আলেয়া চৌধুরী : প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার সহপাঠী ছিলেন। বন্ধুত্ব গভির না হলেও তিনি কলেজের বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে শোভন-সুন্দর আচরণ করতেন। তাঁর মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা তখন থেকেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আমরা তাঁর সম্পর্কে ভীষণ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম। প্রয়াত বেবী মওদুদ (প্রধানমন্ত্রীর এক সময়কার ব্যক্তিগত সহকারী) জেসমিন আমিনের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে পার্টি অফিসে দেখা করার জন্য আমার ক’জন বন্ধুর সাথে আমি ও জেসমিন গিয়েছিলাম। সেদিন চা, মিষ্টি সহ অনেক নাস্তা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করেছিল, সে স্মৃতিও ভোলার নয়। তিনি এখনো আমাকে নববর্ষ, দুই ঈদে কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

আফছার উদ্দিন লিটন: কতো বছর ধরে আপনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন?

আলেয়া চৌধুরী : আমি ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজে যোগদান করি। সেখানে আমি ২৬ বছর ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছি। ওই কলেজে পড়ার সময় থেকেই মহান শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। শত প্রতিকূলতাও আমার আদর্শ থেকে একপা’ও বিচ্যুত করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার উদ্দীপন আনন্দে মানুষের মাঝে সেবা, মায়া-মমতা ও ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়েছি। সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনাকালীন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ৮৬, ৮৭, ৮৮তে ভাল ছাত্রদের বৃত্তি দিয়েছি।

আফছার উদ্দিন লিটন : আপনি একজন উডব্যাজধারী রোভার স্কাউট ছিলেন; স্কাউটিংয়ে আপনার বেশ দক্ষতা রয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই---

আলেয়া চৌধুরী : স্কাউটিংয়ে ছয় বছর সেরা ও ভাল ছাত্রদের পুরস্কার দিয়েছি। কয়েকজন শিক্ষককেও বই পুরস্কার দিয়েছি। হিসাব বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুশান্ত কুমার চৌধুরী, অধ্যাপক সজল বড়ুয়া (দর্শন), বিজ্ঞান প্রদর্শক আফাজুর রহমান, ক্রীড়া শিক্ষক হেলাল উদ্দিন টিপুকে বই পুরস্কার হিসেবে দিয়েছি। উপজেলা পর্যায়ে গোমদন্ডি পাইলট স্কুল, কধুরখিল জলিল আম্বিয়া ডিগ্রি কলেজ, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়েছি। আমার লেখাপড়া শেখাবার কৌশল ভিন্ন ধরনের ছিল। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে আমার আদর্শে তারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অনেক ছাত্র-ছাত্রী দৃষ্টান্ত স্থাপনও করেছিল।

আফছার উদ্দিন লিটন: আপনি নাট্য অভিনয়ের সঙ্গে কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন?

আলেয়া চৌধুরী : আমি স্কুল জীবন থেকেই নাট্যাভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশকার ইবনে শাইখের সফল মঞ্চ নাটক ‘লালন ফকির’, ‘অনেক তারার হাতছানি’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছি। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ‘দুয়ে দুয়ে চার’ নাটকের সহ-নায়িকার ভূমিকায় অংশ নিয়েও বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলাম।

আফছার উদ্দিন লিটন: এ পর্যন্ত আপনার কতটি বই বেড়িয়েছে?

আলেয়া চৌধুরী : মোট ৫টি বই বেরিয়েছে। ‘জীবন-যুদ্ধ-প্রেম’ বর্ধিত কলেবরে তৃতীয় সংষ্করণ আবির প্রকাশন থেকে বের হচ্ছে। এবারের বইটিতে থাকছে গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। বইটি মুজিববর্ষ উপলক্ষে খুব শিগগিরই ২০২১ সালের একুশে বই মেলায় আসবে। এর আগে, ১৯৯০ সালে ঢাকার গণ প্রকাশনী থেকে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নন্দিত সূর্য’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের শৈলী প্রকাশনী থেকে আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘জীবন-যুদ্ধ-প্রেম’ বের হয়। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের শৈলী প্রকাশনী থেকে আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সমীরণে সৌরভে’ বের হয়। ২০০০ সালে চট্টগ্রামের শৈলী প্রকাশনী থেকে আমার চতুর্ত গ্রন্থ ‘মেঘ বৃষ্টি রোদ’ বের হয়। ঢাকার অমর প্রকাশনী থেকে ২০০৮ সালে ‘জীবন-যুদ্ধ-প্রেম’ (দ্বিতীয় খণ্ড) বের হয়। এছাড়া ২০১০ সালে ঢাকার গণ প্রকাশনী থেকে ‘মেঘ বৃষ্টি রোদ’ পাঁচ মিশালি গ্রন্থ বের হয়। আমার সব বই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

আফছার উদ্দিন লিটন: দিন দিন বই পড়া এবং বই কেনা থেকে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে কেন?

আলেয়া চৌধুরী : সমাজের নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ কমে যাওয়ায় পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের বই কেনা ও পড়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষক, অভিভাবক নৈতিক আদর্শ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছি। আকাশ সংস্কৃতি, ফেসবুক ও অনলাইন সংস্কৃতিও এর জন্য অনেকাংশে দায়ি।

 

আফছার উদ্দিন লিটন: আপনি এবং আপনার তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা। কোন সেক্টরে আপনি এবং আপনার ভাইয়েরা যুদ্ধ করেছে?

আলেয়া চৌধুরী : মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টর আমাদের রক্তিম ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে একটি অনন্যা মাইলফলক। এ সেক্টরে আমার চাচাত ভাই শওকত আলী চৌধুরী কাঞ্চন, আমার আপন ছোট দু’ভাই ইকরামুল্লাহ চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় চাকুরিরত আছে। শহীদুল্লাহ চৌধুরী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব: আবুল খায়ের গ্র“পে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছে, বড়ভাই ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমানে ট্রাষ্টি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) এ সেক্টরের অধীনে ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও নোয়াখালীর বিভিন্ন জায়গায় তারা যুদ্ধ করেছে, পাকিস্তানি সেনাদের খতম করেছে, আহত করেছে। আখাউড়া, ভৈরব রেললাইন, কুমিল্লা ও সিলেটের হবিগঞ্জও তাদের যুদ্ধের এলাকা ছিল। এই সেক্টরে ‘৩৫ হাজার গেরিলা সৈনিক যুদ্ধ করেছে বীরত্মের সঙ্গে। এদের মধ্যে আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই, মাহফুজ, মারুফ ও ছিল। নিয়মিত বাহিনীর তিনটি রেগুলার বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন যা পরবর্তীকালে ‘কে ফোর্স (খালেদ ফোর্স) নামে পরিচিত ছিল। সালদা নদী, গঙ্গাসাগর, বিলোনিয়া, ফেনী মিয়া বাজার, চৌদ্দগ্রাম এবং কসবায় প্রায়ই পাক সেনাদের সাথে সংঘর্ষ লেগেই থাকত। (সূত্র-একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি) মেজর খালেদ মোশাররফের পরে দায়িত্ব নেন মেজর হায়দার, তিনি বড় ভাই জাফরুল্লাহ চৌধুরীর খুব কাছের বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী ছিলেন, তিনি কাঞ্চন শহীদ ও আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে না পারলেও বাসায় বসে এলাকার নবীন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে রীতিমত আদেশ দিয়েছিলেন। আমি রাইস, বাবুল, মজনু, মাহফুজ, মারুফ আরো কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলাম, সে স্মৃতি স্মরণে আজও বুক গর্বে ভরে ওঠে। সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে মতি নগরে প্রথম যে হাসপাতাল স্থাপন করলেন, পরে সেটা সরিয়ে ভারতের বিশ্রামগঞ্জে ২৮০ বেডে রূপান্তরিত করা হল, প্রবাসী বাঙালি লন্ডনে এফআরসিএস অধ্যয়নরত ডা. এম.এ.মোবিন এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশের ডাকে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। অর্থাৎ হাসপাতালে যোগ দিয়ে একদিকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করলেন, আরেকদিকে শত্রুদের সাথে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। এ প্রসঙ্গে বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মেডিকেল ছাত্রী ডালিয়া, আসমা, রেশমা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম (মেজর হায়দারের আপন বোন), সবিতা, বড় ও ছোট গীতা এবং শামসুদ্দিনকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তারা যেখানে থাকুক সুস্থ ও সুন্দর থাকুক।

দুই নম্বর সেক্টরকে ছয়টি সাব সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছে এবং দেশকে শত্র“মুক্ত করেছে।
১৯৭১ সালের মার্চে ব্রিটেনে বসবাসরত এক হাজারের ও বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. এএইচ সায়েদুর রহমানকে সভাপতি এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন গঠন করে। ৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন এবং যুক্তরাজ্য যৌথভাবে ডা. এমএ মোবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারতে প্রেরণ করেন। তাঁরা অস্থায়ী (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করেন। সেনাবাহিনীর ডাক্তার (এমএস) সিতারা বেগম এ হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল ঢাকার ইস্কাটন সড়কে পুন:স্থাপিত হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত হয় এবং নামকরণ করা হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র (জিকে)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কর্তৃক বরাদ্দ দেয়া ১৯ একর জমিতে তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশনায় এ হাসপাতালের নাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র (জিকে) রাখা হয়। আজ বঙ্গবন্ধু জন্মশত বার্ষিকী শুভ মুজিব বর্ষে বাংলাদেশ সফল, সার্থক ও সমৃদ্ধ হোক।
আমার এ ভাইটি (জাফরউল্লাহ চৌধুরী) আমার পরিবার ও রাষ্ট্রের গর্ব। মহান আল্লাহ সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সুস্থ ও সুন্দর রাখুক। যাঁরা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছেন, শহীদ হয়েছেন দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন মুজিব শতবর্ষে দোয়া করছি তাঁরা বেহেস্তে থাকুক। তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। তাঁদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সুখে শান্তিতে থাকুক।
(তথ্যসূত্র: ২৫ জানুয়ারি ২০২০ দেশ রূপান্তর, ৭১ এর রণাঙ্গন থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী)

আফছার উদ্দিন লিটন: মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য সরকার থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন?

আলেয়া চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধে আমার অনেক অবদান। আমি আমার বাবা হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরীর দু’নলা পিস্তল, অর্থ, বুদ্ধি, অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে এলাকার অনেক নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন বাবুল (বর্তমানে পিজি’র ডাক্তার), রাইস, সাকিব (প্রয়াত), মজনু, মাহফুজ মারুফকে সহযোগিতা করেছি। আমার ছোট দুভাই ইকরাম উল্লাহ, শহীদ উল্লাহ ও শওকত আলী চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছি। ওরা মুক্তিযুদ্ধের ভাতা পাই কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কিংবা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আমি এ পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাইনি।

 

আফছার উদ্দিন লিটন: কবি, লেখক, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীদের সরকার কিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন?

আলেয়া চৌধুরী: সরকার চাইলে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষকদের নানাভাবে পুরস্কৃত করে অনুদান দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। এরাই দেশের আলোকিত মানুষ। দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবে। সরকার চাইলে তাঁদের প্রচুর বই পাবলিক লাইব্রেরির জন্য কিনেও সহযোগিতা করতে পারে। তাছাড়া জাতীয় পর্যায়ে ঢাকার অমর একুশে বই মেলা সহ বাকি ৬৩টি জেলাতে একুশে বই মেলা উপলক্ষে যে সকল নবীন-প্রবীণ লেখক বই বের করবে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে অনুদান দেয়া উচিত।

আফছার উদ্দিন লিটন:  আপনার কাছে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি মানে কী?

আলেয়া চৌধুরী: বর্তমান সরকার মানুষের কাছে রোল মডেল হলেও বাংলাদেশের অবস্থা আরও সুসংহত হলে দুর্নীতি বন্ধ হলে তবেই বলা যায় বাংলাদেশ সুন্দর সার্থক হয়েছে। কিন্তু দু:খের বিষয় দেশে এখন যোগ্যদের মূল্যায়ন হয়না। গুণীদের মূল্যায়ন হয়না। মূল্যায়ন হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও ভূমিদস্যুদের। মূল্যায়ন হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের। মূল্যায়ন হচ্ছে সন্ত্রাস, চাদাবাজ ও দখলবাজদের। দেশে আজ মেধাবীদের কোনো মূল্যায়ন নেই। সরকারি-বেসরকারী চাকরির ক্ষেত্রে মেধাবীরা আজ বঞ্চিত। সরকারি-বেসরকারী চাকরি এখন মন্ত্রী, এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে। এসব চাকরি তারা তাদের পছন্দের লোক ও আত্মীয়-স্বজনদের দিচ্ছে। চাকরির বাজারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোষ কোথায়। চাকরির বাজারে সাধারণ মানুষের দোষ কোথায়। দেশের রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের কাছে নেই। রাজনীতি এখন ব্যবসায়ী ও অযোগ্য লোকের কাছে। রাজনীতি যোগ্য লোকের হাতে ফিরে আসলে তবে দেশ স্বাধীন সার্বভৌম হবে।  বিশ্বে মাথা উচু করে দাঁড়াতে গেলে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয়।

 

আফছার উদ্দিন লিটন: দিন দিন মানুষের মন থেকে মানবতা, মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে কেন?

আলেয়া চৌধুরী: উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মাথাপিছু আয় না বাড়ায়, অধিকহারে বেকারত্ব বাড়ায় মানুষের মন   থেকে দিন দিন মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পরিবার, সমাজ সবদিক থেকে পেছনে থাকায় মানুষের মাঝে মন মানসিকতার ঘাটতি, সেবা, মায়া-মমতা ও ভালোবাসার অভাবেই সবকিছুর মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে।

 

আফছার উদ্দিন লিটন: সম্প্রতি দেশে গণধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?

আলেয়া চৌধুরী: পরিবার ও সমাজের নানা অবক্ষয়ের কারণে দেশে গণধর্ষণ বাড়ছে। দিন দিন মানুষের নৈতিক চরিত্র অবক্ষয় হচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় মানুষের আয়ের পথ বন্ধ থাকায় নারী নির্যাতন ও গণধর্ষণ বাড়ছে। এছাড়া রাজনৈতিক কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গণধর্ষণ করে দেশকে অস্থিতিশীল রাখছে। যার দৃষ্টান্তমূলক উদাহারণ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধু গণধর্ষনের বিষয়টি।

 

আফছার উদ্দিন লিটন: নারী নির্যাতনের পাশাপাশি দেশে পুরুষ নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। দেশে নারী নির্যাতনের আইন আছে অথচ, পুরুষ নির্যাতনের আইন নেই?

আলেয়া চৌধুরী: এটি সমাজ ধ্বংস হওয়ার আরেকটি পূর্বাভাস। নারী স্বাধীনতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে যা হয় আর কি। বিয়ের দেনমোহরে  কনের পিতা বর পক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা; ক্ষেত্রবিশেষ আরও বেশি দাবি করা হয়। এ নিয়ে যে নারীর উদ্দেশ্য খারাপ সে বিয়ের পরে স্বামীর সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি করবেই। এটি একটি চিন্তার বিষয়। এটি পুরুষ নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। বিয়ের ক্ষেত্রে কনের পিতা বর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি করা, এটিও একটি যৌতুক। মেয়ে বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দেখতে হবে ছেলে সৎ ও স্বশিক্ষিত কিনা। ছেলে মানবিক ও স্বাবলম্বি কিনা। অনেকেরই মেয়ে বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে দেনমোহর নিয়ে ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। তাদের ধারণা, বরের কাছ থেকে দেনমোহর বেশি নিলে মেয়ে শশুর বাড়িতে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয়না। দেখা যায় ওই বরগুলো মাদকাসক্ত, সন্ত্রাস ও কালোবাজারী প্রকৃতির হয়ে থাকে। সৎ মানুষ এত টাকা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করবে না। তাছাড়া আমাদের ইসলাম ধর্মে রয়েছে বিয়ের খরচ ও অপচয় যত কমানো যায়। প্রয়োজনে আর্থিক সামর্থ না থাকলে খেজুর দিয়ে বিয়ে করতে বলেছে। কাজেই বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। সরকারের উচিত পুরুষ নির্যাতনের এ সামাজিক অসঙ্গতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। দাঙ্গাটে প্রকৃতির নারীরা যদি পুরুষ নির্যাতনের জন্য দায়ি হয়; তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নারী নির্যাতনের উপর যেমন আইন আছে, তেমনি পুরুষ নির্যাতনের জন্যও আইন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আফছার উদ্দিন লিটন: কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য আপনি কি কি পুরস্কার পেয়েছেন?

আলেয়া চৌধুরী : আমি সহিত্যকর্মের জন্য লেখিকা সংঘের সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮) ও মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বর্ণপদক (২০০৫) পেয়েছি। এছাড়া বাংলাদেশ শিশু উন্নয়ন মানবাধিকার পদক (২০০৬), বাংলাদেশ মাজার সংস্কার ও সংরক্ষণ কমিটি সম্মাননা পদক (২০০৮), রোভার স্কাউটস বিশেষ সম্মাননা পদক (২০০৮), বাংলাদেশ পোয়েটস্ ক্লাব পদক, বাংলাদেশ মেধা বিকাশ সোসাইটি পদক (২০১২), মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রোটারি পদক (২০১৭) উল্লেখযোগ্য।

আফছার উদ্দিন লিটন:  আমাকে আপনার তথ্যভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আলেয়া চৌধুরী : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনিও বঙ্গবন্ধু, ভাসানির আদর্শে বীরদর্পে এগিয়ে যান এ শুভ কামনায়। আপনার অগ্রযাত্রা কখনো থামবে না। আপনার ক্ষুরধার লেখনি থেকে সমাজ,পরিবার অনেক কিছু শিখবে।  দুর্নীতি কমবে বৈকি।  পরিবর্তন আসবে আশা করা যায়।  

 

 

 

রিলেটেড নিউজ

স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র কোথায়?

মো. রাশেদুল ইসলাম-রাশেদ স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র কোথায়? মো. রাশেদুল ইসলাম রাশেদ   তোমার দেয়া দেশটা শুধু আছে, নাম ভাঙিয়ে খা...বিস্তারিত


দিক হারা পথিক

আফছার উদ্দিন লিটন: দিক হারা পথিক আফছার উদ্দিন লিটন বেকারত্বের অভিশাপে তরুণদের মনে হাহাকার কে দেবে তাদের কর্মসংস্�...বিস্তারিত


জনতা ব্যাংক চাক্তাই শাখার গ্রাহক সমাবেশ অনুষ্ঠিত

চট্টলার ডাক ডেস্ক: জনতা ব্যাংক পিএলসি চাক্তাই শাখার উদ্যোগে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশত “ ৫০ দিনের বি...বিস্তারিত


নারী শুধু ঘর সামলায় না

মো. বেলাল হোসেন চৌধুরী ‘নারী মাঠে যেতে পারে না’-এ কথা আমরা বলতে চায় না। তারা সব পারে; কিন্ত পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান �...বিস্তারিত


দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না কেউ

মো. বেলাল হোসেন চৌধুরী (১) আমি শুধুশুধু অনর্থক যেই ভদ্রলোকটার  বিরুদ্ধে আক্রোশ বা ষড়যন্ত্র করি, পরবর্তীতে দেখা যায় তার অ�...বিস্তারিত


তরুণ প্রকাশকদের অংশগ্রহণে তিনদিনব্যাপী ‌‌প্রশিক্ষণ কর্মশালার সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন

চট্টলার ডাক ডেস্ক: তরুণ প্রকাশকদের অংশগ্রহণে তিনদিনব্যাপী ‌‌'সৃজনশীল প্রকাশনা খাত: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা' শীর্�...বিস্তারিত